পর্ব ১-
নেপালে একটুকরো তিব্বত..
৭ দিনের অনুমতি পেয়ে প্রবেশ করি নিষিদ্ধ স্যুম উপত্যকায়.. উপত্যকার ক্যানভাস হিসেবে পাই গণেশ হিমাল আর স্রিঙ্গী হিমাল নামের দুই ৭০০০+ মিটার পর্বত কে.. উঁচু নিচু পথে হাঁটতে গিয়ে দেখা মেলে দুই খরস্রোতা নদী বুড়িগান্ধকি আর সিয়ারখোলার..
সুন্দরের মাঝে খলনায়ক হিসেবে প্রতিদিন ই পেয়েছি ল্যান্ড স্লাইড এরিয়া বা রক ফল এরিয়া, তাতে থাকতো সরু পথের সাথে উপর থেকে গড়িয়ে আসা পাথর ফ্রী!
পাথরের গায়ে প্রার্থনা খোদাই করা.. এমন অসংখ্য পাথর দিয়ে বানানো দেয়াল- যার নাম ‘মানি’.. এর বাম পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া নিয়ম… পথ চলতে দেখা মেলে এমন হাজারটা মানির.. তার বেশিও হতে পারে! কিছু কিছু মানির মাথায় শিং দেখেছি..
তাশিদেলে! (Tashi delek)
অমলিন হাসির সাথে তিব্বতিয়ান অভ্যর্থনা..
এই উপত্যকায় নাম না জানা কত যে ফুলের দেখা পেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই.. শুধু ফুল নিয়েই একটা আলাদা এলবাম করা যাবে!
এখানে যেহেতু প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ, তাই দেখা মিলেছে uniquely rich wildlife এর.. হিমালয়ান থর, হিমালয়ান ইঁদুর, বানর, সাপ, হরেক রকমের গিরগিটি, ইয়াক, ঘোড়া, প্রতিটা বাড়িতে কুকুর, বিড়াল,মোরগ, আর ভারবাহী খচ্চর..
তাহলে শুরু করা যাক প্রাণপ্রাচুর্যে পরিপূর্ণ স্যুম উপত্যকার গল্প ~
পর্ব ২ –
স্যুম উপত্যকায় প্রবেশের উদ্দেশ্যে আমাদের হাঁটা শুরু হয় মাছাখোলা থেকে, ৩০ এপ্রিল ২০২২ এ..
মাছা মানে মাছ আর খোলা অর্থ নদী.. বলাই বাহুল্য এই গ্রামের অধিকাংশের জীবিকা মাছের উপর নির্ভরশীল! যদিও দূর্ভাগ্যবশত আমরা কোনো মাছের দেখা পাইনাই
আগের দিন আমরা কাঠমান্ডু থেকে গাড়ি চড়ে মাছাখোলা এসে থামি.. সারাদিনের ভ্যাপসা গরমের পর রাতে সিজনের প্রথম ঝড় বয়ে যায়.. ঘুমটাও তাই বেশ ভালো হয়!
বৃষ্টিস্নাত স্নিগ্ধ পাহাড়ি ভোরের রূপ বর্ণনা আমার মত নাদানের পক্ষে সম্ভব না!
মাছাখোলার সকালে মধু নিয়ে একটা মজার ঘটনা ঘটে.. বিশুদ্ধ হিমালয়ান মধু পেয়ে আমার কক্ষবন্ধু সহ আরো ক’জনের চেটেপুটে মধু খাওয়া দেখে লজের মালকিন কঠিন চেহারায় এসে ওটা বদলে ডাবর হানি দিয়ে যান
তাই নিয়ে হাসাহাসি আর নাস্তা সেরে ব্যাকপ্যাক কাঁধে বেরিয়ে পড়ি আমরা.. কিছুটা হাঁটতেই পেয়ে যাই খোরলাবেশি নামের ছোট্ট একটা গ্রাম.. তারপর আসে তাতোপানি.. তাতো মানে গরম.. এখানে প্রাকৃতিক একটা হট-স্প্রিং-চৌবাচ্চা আছে, যাতে কনকনে ঠান্ডায় ও গরম পানি বিদ্যমান!
কথায় আছে,
When life gives you tatopani, make coffeee
আমরাও ঝটপট মগ বের করে কফি ব্রেক নিয়ে নিলাম!
এই হল সেই তাতোপানি.. ভিডিও গ্রহণে তানভির ভাই
পর্ব ৩ –
সকালে মেঘলা আকাশ সাথে নিয়ে বেরুলেও, তাতোপানি পার হতে হতে সূর্য উঁকি দিতে শুরু করলো..(আগের পর্বে তাতোপানির গল্প আছে)
বুড়িগান্ধাকির কিনার দিয়ে একটা মোটামুটি খোলা জায়গা পার করে কিছু রোড কন্সট্রাকশনের তাবুর পাশ কেটে দেখা মিললো প্রথম দিনের প্রথম ঝুলন্ত ব্রিজের.. চলে এলাম এপারে দোভান নামের সুন্দর সাজানো গ্রামটায়, যেখানে সবগুলো ঘরের চাল নিল রঙের.. হোমস্টে গুলোর সামনে নানা রঙের ফুল.. ছিমছাম এই গ্রাম টাকে বামে রেখে ডানের পাথুরে ট্রেইল ধরে আস্তে আস্তে উঠতে থাকলাম আমরা।
দোভান থেকে সাউলিভাট্টি পর্যন্ত পুরোটাই পাথুরে পথের চড়াই.. পেট জানান দিয়ে দিল দুপুর হয়ে গেছে ততক্ষণে! লাঞ্চে দেখা মিললো আমাদের সামনেই ২-৩ টা গাছে কয়েকটা বানর পরিবারের! নবজাতক থেকে বুড়ো থুরথুরে বানরের এমন একান্নবর্তী পরিবার দেখা মেলা ভার বৈকি!
সাউলিভাট্টিতে ডাল-ভাত খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটা শুরু.. এলাম থুলোডুঙ্গা নামের ছোটো একটা গ্রামে.. থুলোডুঙ্গার শুরুর পাথুরে পথটা পার হয়ে দেখা মিললো সমতল একটা সবুজ ভ্যালির..
পাথুরে ও সমতল দুরকম পথ পেরিয়ে চলে এলাম এমন এক জায়গায় যেখানে উপর দিকে তাকালে শুধু ঝুলন্ত পাথর চোখে পড়ে! এটা একটা বিশাল রক ফল এরিয়া.. এই ট্রেকের অন্যতম একটা খারাপ জায়গা.. গতবছর এই জায়গার ট্রেইলটি পুরোপুরিভাবে ধ্বসে যাওয়ার পর একটি দুরুহ পায়ে চলার পথ বের করেছে স্থানীয়রা বিরাট সব বোল্ডারের মধ্য দিয়েই! যা পার হতে আমাদের প্রায় এক ঘন্টা সময় লেগেছিলো.. তার উপর ষোলকলা পূর্ণ করতে বৃষ্টি ও হাজির ততক্ষণে
বৃষ্টি তেও ঘেমে যাচ্ছিলাম টেনশনে.. একটু পা ফসকালেই নিচে বুড়ি গান্ধাকিতে পড়বো, আর উপরে পাথর ফসকালে হব চিড়ে-চ্যাপ্টা
যা হোক.. এভাবে আস্তে আস্তে চলে এলাম ইয়ারুবাগার নামের ছোটো আরেকটা গ্রামে.. লোকালদের কাছ থেকে জানতে পারলাম এই নামের অর্থ সৈকত..
গ্রাম টা বুড়িগান্ধাকির তীরে অবস্থিত বলেই নাকি এই নাম!
বৃষ্টি বাড়ার কারণে ঠিক হল ইয়ারুবাগারেই আমরা থেকে যাবো রাত টা.. শুনেই খুশি হয়ে গেলাম! পা টিপে টিপে ১ ঘন্টার রক ফল এরিয়া পার হওয়ার ক্লান্তিতে তখন ই পারলে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে নিই আমি!
আমার সেই খুশিতে পানি ঢেলে বৃষ্টি কমে গেলো এবং আমার হাইলি এনার্জেটিক টিম হাঁটা শুরু করলো
চলে এলাম বুড়িগান্ধাকির তীরে একটা নিচু সমতল ভুমিতে.. ডানে উপরের দিকে তাকালে দেখা মিললো পাহাড়ের গা ঘেষে ঝুলে থাকা একটা ব্রিজের.. Cantilever bridge বলা হয় এধরণের ব্রিজ কে।
আগে নাকি ওই পথেই জগৎ যাওয়া হত.. কিন্তু ২ বছর ধরে ভাঙা ব্রিজ টা আর রিপেয়ার করা না হওয়ায় শুকনো নদীর মাঝখান দিয়ে এখন যেতে হয়..
দুপাশে খাড়া পাথুরে দেয়ালের মাঝখান দিয়ে হেঁটে উপর দিকে কিছুটা উঠতেই জ্যামে পড়লাম.. খচ্চরের জ্যাম!
যেহেতু ট্রেইল টা জিগজ্যাগ এবং সরু, এসময় অবশ্যই পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়াতে হয়.. কিনারে দাঁড়ালে কপাল খারাপ থাকলে, খচ্চর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ধাক্কা লেগে প্রপাত ধরণীতল হতে পারে
জ্যাম পার হয়ে হেঁটে চলে এলাম সেদিনের দ্বিতীয় ঝুলন্ত ব্রিজে, যার ঠিক গোড়ায় রয়েছে ‘একলাভাট্টি’.. এই নামের অর্থ একলা ঘর.. এখানে একটা পরিবার থাকে, তাই এর নাম একলাভাট্টি!
ঝুলন্ত ব্রিজ এর উপর দিয়ে আরেকবার বুড়িগান্ধাকি নদী পার হয়ে অনেকখানি চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা জগৎ এসে পৌঁছলাম! প্রায় ২১ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম ও ৪৭০+ মিটার উচ্চতা শিকার করতে আমাদের সেদিন সময় লেগেছিলো প্রায় ৭ ঘন্টার মত, যার বড় অংশ কেটেছে রক ফল এরিয়া পার হতে, বৃষ্টির কারণে ইয়ারুবাগারে বসে এবং খচ্চরের জ্যামে আটকা পড়ে
এভাবেই শেষ হল আমাদের প্রথম দিনের ট্রেক!
পর্ব ৪ –
প্রথম রাতে জগতে একটা হোমস্টে’র ৪ তলায় ছাদ লাগোয়া ঘরে ছিলাম.. সন্ধ্যে নামতেই হাড় কাঁপিয়ে ঠান্ডা বাতাস বওয়া শুরু হল.. যাকে বলে একেবারে মানুষজনের টি শার্ট উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হাওয়া
আমাদের নেপাল- প্রীতি দেখে আম্মু প্রায়ই জিজ্ঞেস করেন, নেপালে গিয়ে তোরা করিস কি?
নেপালে আমরা এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে গিয়ে হিমালয়ান হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া টি-শার্ট কুড়িয়ে আনি আর সঙ্গী-সাথীরা উপর থেকে টর্চের আলো ফেলে আমাদের পথ সুগম করে দেয়
রাতে ডাল-ভাত- চা-আড্ডা-পরদিনের প্ল্যান শেষে প্রথম দিনের হাঁটার ক্লান্তিতে শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়লাম..
সকালে নাস্তা সেরে ‘জগত’ গ্রাম টাকে দিনের আলোয় ভালোভাবে দেখার সুযোগ হল.. পরিষ্কার একটা গ্রাম.. পাথরের তৈরি ঘর, হাঁটাপথ, দেয়াল আর স্তুপা.. ভিন্টেজ একটা ভাব আছে গ্রাম টায়…
দারুন
ধন্যবাদ 🙂
গল্পটা শেষ করেন
ইনশাআল্লাহ দ্রুত শেষ করবো